TOP NEWS

Tuesday, April 5, 2011

ইন্দ্রলাল রায়: প্রথম বাঙালি ফাইটার পাইলট ও প্রথম মহাযুদ্ধের বিস্মৃতপ্রায় এক বীরসেনানী






দিনটি ছিল ১৯ জুলাই ১৯১৮। প্রথম মহাযুদ্ধ চলছে। ফ্রান্সের আকাশে জার্মান বিমানবাহিনী ও ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনী তুমুল আকাশযুদ্ধে লিপ্ত। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ ফাইটার পাইলট সেদিন ডগফাইটের সময় একটি জার্মান জঙ্গীবিমান গুলি করে ভূপাতিত করলেন। এটি ছিল তাঁর দশম শত্রুবিমান শিকার–যে কৃতিত্বের জন্য তিনি পেয়েছিলেন ‘ফ্লাইং এইস’ (Flying Ace) খেতাব।
এই খেতাব পাওয়ার জন্য যেখানে সাধারণত পাঁচটি শত্রুবিমান ঘায়েল করাই যথেষ্ট, সেখানে তিনি খতম করেছিলেন দশটি! আকাশযুদ্ধের সেই প্রথম যুগে, সদ্যযুবক এক ফাইটার পাইলটের মাত্র তের দিনের, ১৭০ উড়াল-ঘন্টার এক অতি-সংক্ষিপ্ত লড়াই-জীবনের পক্ষে এটি ছিল এক অসামান্য বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্ব–যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই অকুতোভয় বীরসেনানীর নাম ইন্দ্রলাল রায়–প্রথম বাঙালি ফাইটার পাইলট এবং প্রথম বাঙালি বা ভারতীয় ‘ফ্লাইং এইস’।
বরিশালের এক জমিদার পরিবারের সন্তান ইন্দ্রলাল রায় ১৮৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ব্যারিস্টার পি. এল. রায় ও মাতার নাম ললিতা রায়। পড়াশোনার জন্য দশ বছর বয়সে তাঁকে লন্ডনে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এরপর তিনি অক্সফোর্ডে পড়ার জন্য বৃত্তিলাভ করেন।
কিন্তু অক্সফোর্ডে পড়তে না গিয়ে তিনি বিমানচালনার নেশায় ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে ১৮ বছর বয়সে ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনী (Royal Flying Corps)-তে  অফিসার ফ্লাইং ক্যাডেট হিসেবে নাম লেখান। একই বছরের ৫ জুলাই তারিখে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। পেশাগত প্রশিক্ষণশেষে তিনি ৩০ অক্টোবর ১৯১৭ তারিখে ফ্রান্সে যুদ্ধরত রাজকীয় ৫৬ স্কোয়াড্রনে যোগ দেন।
এর কিছুদিন পরই, ৬ নভেম্বর ১৯১৭ তারিখে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে তিনি গুরুতর আহত হন। কথিত আছে, হাসপাতালে নেওয়ার পর প্রথমে তাঁকে ‘মৃত’ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তিনি বেঁচে ওঠেন। তবে তাঁকে শারীরিক কারণে ‘গ্রাউন্ডেড’ করা হয়। তারপর তিনি অনেক সাধ্য-সাধনা করে, পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও, আবার সক্রিয় যুদ্ধে ফিরে যান এবং তাঁকে লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। ১৯১৮ সালের  ১৯ জুন তারিখে তাঁকে ফ্রান্সে যুদ্ধরত রাজকীয় ৪০ স্কোয়াড্রনে বদলি করা হয়।
আকাশযুদ্ধে তাঁর প্রথম সাফল্য আসে ৬ জুলাই ১৯১৮ তারিখে একটি জার্মান জঙ্গীবিমান ধ্বংস করার মাধ্যমে। এরপর তিনি ৮ জুলাই তারিখে চার ঘন্টায় তিনটি; ১৩ জুলাই দুইটি; ১৫ জুলাই দুইটি; এবং ১৮ জুলাই তারিখে একটি শত্রুবিমান ধ্বংস করেন। তাঁর সবশেষ সাফল্য আসে ১৯ জুলাই তারিখে, যার কথা লেখার প্রথমেই বলেছি। ৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত মাত্র তের দিনে দশটি শত্রুবিমান ঘায়েল করে তিনি ঠাঁই পেয়ে যান ইতিহাসের পাতায়।
এর তিন দিন পর, ২২ জুলাই ১৯১৮ তারিখে ফ্রান্সের আকাশে জার্মান বিমানবাহিনীর সাথে এক সম্মুখ যুদ্ধে তাঁর এসই-৫এ বিমানটি ফ্রান্সের জার্মান অধিকৃত এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। জার্মান সেনারা তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে সেখানেই সমাহিত করে। কথিত আছে, তাঁর অসাধারণ বীরত্বের কথা মনে রেখে সেই জার্মান শত্রুসেনারাও তিনি যেখানে পতিত হয়েছিলেন, সেখানে ফুলের তোড়া রেখে আসে। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনী তাঁর অসামান্য কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে মরণোত্তর, অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ‘ডিস্টিংগুইশড ফ্লাইং ক্রস’ (DFC) পদকে ভূষিত করে।
ভারত সরকার ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইন্দ্রলাল রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করে। এছাড়া ফ্রান্সে তাঁর সমাধির ওপর বাংলা ও ফরাসি ভাষায় গৌরবগাঁথা লেখা হয়। তাঁর নামে কলকাতায় একটি সড়কও রয়েছে। এই বাঙালি বীরের পরিবারের আরেক সন্তান, এয়ার মার্শাল সুব্রত মুখার্জিও ছিলেন একজন ফাইটার পাইলট ও স্বাধীন ভারতের প্রথম বিমানবাহিনী প্রধান।
আমরা কয়জন জানি এই বাঙালি বীরসন্তানের নাম?
তথ্যসূত্র:
১। এশিয়ান্‌স ইন ব্রিটেন: ফোর হান্ড্রেড ইয়ার্‌স অব হিস্ট্রি, রোজিনা ভিস্রাম, ২০০২।
২। উইকিপিডিয়া
৩। হাবপেজেস ও অন্যান্য।
প্রকাশিত লিংক:
১। সোনার বাংলাদেশ ব্লগ।
২। মুক্তব্লগ।
৩। নাগরিক ব্লগ।
৪। চতুর্মাত্রিক ব্লগ।
৫। শব্দনীড়।
৬। আমার ব্লগ।
৭। আমার বর্ণমালা ব্লগ।
৮। বিডিনিউজ২৪ ব্লগ

0 comments: