যাদের জন্য ফেরেশতাগণ কল্যাণের, সাহায্য ও নিরাপত্তা চেয়ে আল্লাহর নিকট দো’আ করেন তারা অনেক। এদের অন্যতম হলোঃ
* মুহাম্মাদ (সা)
* নবী (সা) এর উপর দুরূদ পাঠকারী
* অযু অবস্থায় ঘুমন্ত ব্যক্তি
* সালাতের অপেক্ষাকারী মুসল্লি
* প্রথম কাতারের মুসল্লি
* সালাতের লাইনের ডান পাশের মুসল্লিদের জন্য
* কাতারে পরস্পর মিলিতভাবে দাঁড়ানো মুসল্লিদের জন্য
* ইমামের এর সূরা ফাতিহা শেষ করার পর আমীন পাঠাকারীবৃন্দের জন্য
* সালাত সমাপ্তির পর অজুসহ স্ব-স্থানে অবস্থানকারীর জন্য
* জামাতের সাথে ফজর ও আসর সালাত আদায়কারীর জন্য
* কুর’আন খতমকারীর জন্য
* মুসলম ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দু’আকারীর জন্য
* কল্যাণের পথে ব্যায়কারীর জন্য
* সেহেরী ভক্ষণকারীদের জন্য
* রোগী প্রদর্শনকারীর জন্য
* সৎ কাজের শিক্ষা প্রদানকারীর জন্য
* মু’মিন ও মু’মিনদের আত্মীয় ও তাওবাকারীদের জন্য
আসুন! আমরা বিস্তারিত জেনে নেই।
মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জন্যে
আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এ সম্পর্কে আল্লাহ্* তা‘য়লা বলেনঃ
“নিশ্চই আল্লাহ্* নাবীর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তার ফেরেশতারাও নাবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। হে মু‘মিনগণ তোমরাও নাবীর জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা কর এবং তাকে যথাযথভাবে সালাম জানাও”।
(সূরা আহযাবঃ ৫৬)
নাবী (সাঃ)-এর উপর দরূদ পাঠকারীর জন্য
এর প্রমান হলো ইমাম আহমদ (রহ.)-এর বর্ণিত নিম্ন হাদীস।
আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি রাসুল (সাঃ)-এর উপর একবার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ্* তা‘আলা তার উপর সত্তর বার দয়া করেন ও তার ফেরেশতারা তার জন্য সত্তর বার ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অতএব, বান্দারা অল্প দরূদ পাঠ করুক বা অধীক দরূদ পাঠ করুক। (আল-মুসনাদ, হাদীস – ৬৬০৫,৬৩১৭)
অযু অবস্থায় ঘুমন্ত ব্যক্তির জন্য
এর প্রমানে হাদীসে এসেছে,
ইবনে উমার থকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের এই শরীর সমূহকে পবিত্র রাখ। আল্লাহ্* তোমাদেরকে পবিত্র করবেন। যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (অযু অবস্থায়) রাত অতিবাহিত করবে, অবশ্যই একজন ফেরেশতা তার সঙ্গে রাত অতিবাহিত করবে। রাতে যখনই সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে তখনই সে ফেরেশতা বলে, হে আল্লাহ্* আপনার এই বান্দাকে ক্ষমা করুন। কেননা সে পবিত্রাবস্থায় (অযু অবস্থায়) ঘুমিয়েছে। (আত-তারগীব ওয়াত তাহরীব)
হাফেজ ইবনে হাযার আসকালানী বলেন, হাদীসের মান জাইরিদ বা ছহীহ হাদীসের অন্তর্ভুক্ত।
অন্য বর্ণনায় এসেছে অযু অবস্থায় ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হলেও ফেরেশতা তার জন্য দু‘আ করেন। রাসুল (সাঃ) বলেন,
যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (অযু অবস্থায়) ঘুমায় তার সঙ্গে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকে, সে ঘুম থেকে জাগ্রত হলে ফেরেশতা বলেন, হে আল্লাহ্*! তোমার অমুক বান্দাকে ক্ষমা করে দাও, কেননা, সে পবিত্রাবস্থায় ঘুমিয়েছে। (ইবনে হিব্বান)
শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেন, হাদীসটি সহীহ।
ছালাতের অপেক্ষাকারী মুছল্লীবৃন্দের জন্য
হাদীসে এসেছেঃ
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি যখন অযু অবস্থায় ছালাতের অপেক্ষায় বসে থাকে, তার জন্য ফেরেশতা মন্ডলী দু‘আ করে থাকেন, হে আল্লাহ্*! তুমি তাকে ক্ষমা কর, হে আল্লাহ! তুমি তার উপর কল্যাণ দান কর। (মুসলিম)
প্রথম কাতারের মুছল্লীবৃন্দের জন্য
নিম্নে একটি হাদীস প্রদত্ত হলঃ
রাসুল (সাঃ) বলতেনঃ প্রথম কাতারের মুছল্লীদের উপর নিশ্চই আল্লাহ্* ক্ষমা করবেন ও ফেরেশতা মন্ডলী তাদেরজন্য দু‘আ করবেন। (ইবনে হিব্বান)
আল্লামা শায়খ শুয়াইব আরনাউত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
সালাতের লাইনের ডান পার্শ্বের মুসল্লীবৃন্দের জন্য
রাসুল (সাঃ) বলেন,
নিশ্চই আল্লাহ্* দয়া করেন ও ফেরেশতামন্ডলী দু‘আ করেন ডান পার্শ্বের দাঁড়ানো ব্যক্তিদের উপর। (ইবনে হিব্বান)
হাদীসটি হাসান।
কাতারে পরস্পর মিলিতভাবে দাঁড়ানো মুছলীবৃন্দের জন্য
রাসুল (সাঃ) বলেন,
নিশ্চই আল্লাহ্* দয়া করেন এবং ফেরেশতামন্ডলী দু‘আ করে, যারা পরস্পর একে অপরের সাথে লাইন মিলিয়ে সালাত আদায় করে। (ইবনে হিব্বান)
শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
এই কারণে সাহাবাগণ জামাতে সালাত আদায়কালীন পরস্পর মিলিত হয়ে দাঁড়ানোতে গুরুত্ব দিতেন।
বিশিষ্ট সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, আমাদের সবাই সালাতে একে অপরের কাঁধের সাথে কাঁধ এবং পায়ের সাথে পা মিলাতাম। (বুখারী)
রাসুল (সাঃ) সালাত আরম্ভের পূর্বে মুছল্লীদের দিকে তাকিয়ে বলতেনঃ
তোমরা তোমাদের কাতার সোজা কর তিনবার বলতেন। আল্লাহর শপথ! তোমাদের কাতারকে সোজা কর, অন্যথায় আল্লাহ্* তোমাদের অন্তরের মাঝে বক্রতা সৃষ্টি করবেন। বর্ণনাকারী কাতার সোজা করার নিয়মাবলী এভাবে বর্ণনা করেন। আমি দেখেছি ব্যক্তি তার নিজের কাঁধ অপরের কাঁধের সাথে, হাটু অপরের হাটুর সাথে এবং পা অপরের পায়ের সাথে মিলিয়ে দাঁড়াতেন। (বুখারী)
ইমাম এর সূরা ফাতিহা শেষ করার পর আমীন পাঠকারীবৃন্দের জন্য
এ মর্মে রাসুল (সাঃ) বলেন,
যখন ইমাম বলবে, ( غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ),তখন তোমরা আমীন বল। কেননা, যার আমীন বলা ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যাবে, তাঁর অতীত জীবনের গোনাহগুলীকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। (আল জামি, মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল)
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় ইমাম সূরা ফাতিহা সমাপ্ত করার পর ফেরেশতা সমবেতারা মুসল্লীদের জন্য আমীন বলে আল্লাহর সমীপে সুপারিশ করে থাকেন, যার অর্থ হলঃ হে আল্লাহ্* আপনি ইমাম ও মুছল্লীদের সূরা ফাতিহায় বর্ণিত দু’আ সমূহ কবুল করুন। কারণ, আমীন অর্থ হলো আপনি কবুল করুন। (ফাতহুল বারী)
সালাত সমাপ্তীর পর অযুসহ স্ব স্থানে অবস্থানকারী বৃন্দের জন্যে
এ প্রসঙ্গে রাসুল (সাঃ) বলেন,
তোমাদের মধ্যে যারা সালাতের পর স্বস্থানে বসে থাকে, তাদের জন্য ফেরেশতা দু’আ করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর অযু ভঙ্গ না হবে, (দু’আটি হল এইঃ) হে আল্লাহ্*! আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং হে আল্লাহ্*! আপনি তাদের উপর দয়া করুন। (মুসনাদে আহমাদ)
শায়খ আহমদ শাকির হাদীসটি সহীহ বলেছেন।
জামাতের সাথে ফজর ও আসর সালাত আদায়কারীর জন্য
হাদীসে এসেছে,
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, রাতের ও দিনের ফেরেশতারা ফজর ও আসর সালাতে একত্রিত হয়। ফজর সালাতে রাতের ফেরাশতারা উপরে উঠে যায়, এবং দিনের ফেরেশতারা মানুষের নিকট থেকে যায় এবং আসর সালাতে একত্রিত হয়ে দিনের ফেরেশতারা চলে যায় এবং রাতের ফেরেশতারা থেকে যায়। তাদেরকে আল্লাহ তায়লা জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমার বান্দাদেরকে কোন অবস্থায় ছেড়ে এসেছ? ফেরেশতারা উত্তরে বলেন, আমরা যখন তাদের নিকট উপস্থিত হয়েছিলাম, তখন তাদেরকে সালাতরত অবস্থায় পেয়েছিলাম এবং যখন আমরা তাদের ছেড়ে এসেছি তখনও তাদেরকে সালাতের অবস্থায় ছেড়ে এসেছি। অতঃএব আপনি তাদেরকে কিয়ামত দিবসে ক্ষমা করুন। (মুসনাদে আহমাদ)
হাদীসটি সহীহ।
শায়খ আহমদ বিন আব্দুর রহমান আল-বান্না ফেরশতাদের দু’আর ব্যাখ্যায় বলেনঃ এমন ব্যক্তির জন্য ফেরেশতারা কিয়ামত দিবসে আল্লাহ্* তা’আলার সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
আল-কুরআন খতমকারীর জন্য
ইমাম দামিরী (রহ.) সা’আদ (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ
কুরআন খতম যদি রাত্রির প্রথম ভাগে হয় তবে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতারা খতমকারীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে আর রাত্রির শেষ ভাগে হলে সকাল পর্যন্ত ফেরেশতারা তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। অনেক সময় আমাদের মাঝে অল্প কিছু বাকি থাকত তা আমরা সকাল বা সন্ধ্যা পর্যন্ত বিলম্ব করতাম। (সুনানি দামিরী)
হাদীসটি যঈফ। কিন্তু একাধিক সানাদে বর্ণিত হওয়ায় মুহাদ্দিসগন হাসান বলেছেন।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবদাহ বলেন,
যখন কোন ব্যক্তি দিনের বেলায় কুরআন খতম করে, ফেরেশতারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর জন্য দু’আ করতে থাকে এবং যদি রাত্রে খতম করে তবে ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। হুসাইন সিলীম আসাদ বলেন, এটি ছহীহ। (সুনানি দামিরী)
মুসলিম ভাইয়ের কল্যাণের জন্য দু‘আকারীদের জন্য
এ প্রসঙ্গে ইমাম মুসলিম (রহ.) হাদীস সংকলন করেছেন। নিচে তা উল্লেখ করা হলঃ
সাফওয়ান (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি আব্দুল্লাহ বিন সাফওয়ানের ছেলে ও দারদার স্বামী ছিলেনঃ তিনি বলেন, আমি শামে গেলাম। তারপর আমি আবু দারদার ঘরে উপস্থিত হলাম; কিন্তু আমি তাকে ঘরে পেলাম না, উম্মুদ দারদা (রহ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ হলো, তিনি বললেন, এ বছর তোমার কি হাজ্জ করার ইচ্ছা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ,। তিনি বললেন, আমাদের মঙ্গলের জন্য দু’আ করবেন। কেননা, নাবী (সা.) এরশাদ করেছেন, কোন মুসলিম তাঁর অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দু’আ করলে তা কবুল করা হয় এবং তাঁর মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকেন, যখনই সে ব্যক্তি তাঁর ভাইয়ের জন্য মঙ্গলের দু’আ করে তখন সে নিযুক্ত ফেরেশতা বলে, আমীন অর্থাৎ হে আল্লাহ্* কবুল করুন এবং তোমার জন্য অনুরূপ। (অর্থাৎ তোমার ভাইয়ের জন্য যা চাইলে, আল্লাহ্* তোমাকেও তাই দান করুন)। (মুসলিম, আহমাদ)
ফেরশতাদের দু’আ পাওয়ার প্রত্যাশায় অতীত যামানার মনীষীগণ অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য দু’আ করাতে অনেক গুরুত্ব দিতেন এবং আল্লাহ্* তা’আলার অনুগ্রহে বর্তমানেও দিচ্ছেন।
কাজী ইয়াজ (রহ.) বলেনঃ সালফে সালেহীনগণ যখন নিজের জন্য দু’আ করার ইচ্ছা পোষণ করতেন তখন তারা অনুপস্থিত মুসলিম ভাইয়ের জন্য দু’আ করতেন। কেননা, এমন দু’আ কবুল হয়ে যায় এবং ফেরেস্তামন্ডলী দু’আকারীর জন্য ঐ দু’আই করে থাকেন।
হাফেজ যাহাবী (রহ.) উম্মুদ দারদা (রহ,)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, আবু দারদা (রা.)-এর তিনশত ষাটজন বন্ধু ছিল, ছালাতে তাদের জন্য দু’আ করতেন। এ সম্পর্কে তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করলে তদুত্তরে তিনি বলেন, আমি চাইব না যে, ফেরেশতারা আমার জন্য দু’আ করুক? কুরআন মাজীদ সেই সকল মু‘মিনদের প্রশংসা করেছে যারা অতীত মু‘মিনদের জন্য দু’আ করেন।
আল্লাহ্* তা’আলা বলেন,
যারা তাদের পরে আগমন করেছে, তারা বলে যে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রনী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করুন এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! আপনি দয়ালু ও পরম করুণাময়। (সূরা হাশরঃ ১০)
শায়খ মুহাম্মাদ আল্লান সিদ্দীকি (রহ.) এ আয়াত সম্পর্কে লিখেছেনঃ আল্লাহ্* তা’আলা অনুপস্থিত মুসলিম ভাইয়ের জন্য দু’আ করার জন্য তাদের প্রশংসা করেছেন।
কল্যাণের পথে ব্যয়কারীদের জন্য
নিম্নে হাদীস সমূহ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। ইমাম বুখারী (রহ.) ও ইমাম মুসলিম (রহ.) বর্ণনা করেন।
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরন করেন, একজন বলেন, হে আল্লাহ্*! দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দাও, অপরজন বলেন, হে আল্লাহ্*! যে দান করে না তার সম্পদকে বিনাশ করে দাও। (বুখারী)
এই হাদীসে নাবী (সা.) তাঁর উম্মাতকে এ সংবাদ প্রদান করেছেন যে, ভাল পথে ব্যয়কারীর জন্য ফেরেশতারা দু’আ করেন, আল্লাহ্* তাদের খরচকৃত সম্পদের প্রতিদান দান করুন।
আল্লামা আয়নী (রহ.) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ ফেরেশতাদের দু’আর অর্থ হলো, সৎ পথে ব্যয় করার দরুন যে সম্পদ তোমাদের হাত ছাড়া হলো আল্লাহ্* তা’আলা তাঁর বিনিময় দান করবেন।
মোল্লা আলী কারী (রহ.) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেনঃ ফেরেশতাদের দু’আয় যে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এর অর্থ হলো মহাপুরুস্কার।
হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) এর হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি চমৎকার কথা বলেছেন, ফেরেশতাদের দু’আয় সৎপথে ব্যয় করার পুরুস্কার নির্দিষ্ট নয় কেননা, এর তাৎপর্য হলোঃ যাতে করে এতে সম্পদ, সাওয়াব ও অন্যান্য জিনিসও শামিল হয়। সৎপথে ব্যায়কারীদের অনেকেই উক্ত সম্পদ ব্যয়ের প্রতিদান পাওয়ার পূর্বেই ইন্তিকাল করেন এবং প্রতিদান নেকীর আকারে পরকালে অবধারিত হয় অথবা উক্ত খরচের বিনিময় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে যাওয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। (ফাতহুল বারী)
ইমাম আহমেদ বিন হাম্মাল, ইমাম ইবনু হিব্বান ও ইমাম হাকিম (রহ.) বর্ণনা করেছেন।
আবু দারদা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, প্রতি দিন সূর্য উদয়ের সময় তার দুই পার্শ্বে দুই ফেরেশতাকে প্রেরণ করা হয়, তারা বলতে থাকে, হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের রবের দিকে অগ্রসর হও। পরিতৃপ্তকারী অল্প সম্পদ, উদাসীনকারীর অধিক সম্পদ হতে উত্তম। তাদের কথা মানুষ ও জীন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়। অনুরূপ সূর্য ডুবার সময় তার পার্শ্বে দুই ফেরেশতা প্রেরণ করা হয়, তারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ্*! দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও। তাদের কথা মানুষ ও জীন ব্যতীত সবাই শুনতে পায়। (আল মুসনাদ, ইবনে হিব্বান)
ইমাম আহমদ ও ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) এভাবে সংকলন করেছেন।
আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি রাসুল (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, জান্নাতের দরজার পার্শ্বে ফেরেশতা বলেনঃ যে ব্যক্তি আজ ঋণ (আল্লাহ্*র রাস্তায় দান করবে) দিবে, তার প্রতিদান পাবে আগামীকাল (কিয়ামত দিবসে)।আর অন্য দরজায় এক ফেরেশতা দাঁড়িয়ে বলেনঃ হে আল্লাহ্*! দানকারীর সম্পদ বৃদ্ধি করে দাও এবং যারা দান করে না তাদের সম্পদকে ধ্বংস করে দাও। (আল মুসনাদ, ইবনে হিব্বান)
সাহরী ভক্ষণকারীদের জন্য
এর প্রমাণ স্বরূপ নিম্নে একটি হাদীস উল্লেখ করা হলঃ
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, সাহরী খাওয়াতে বারাকাত (বরকত) রয়েছে, সাহরী কখনো ছাড়বে না যদিও এক ঢোক পানি পান করেও হয়। কেননা, নিশ্চই আল্লাহ্* তা’আলা সাহরী গ্রহণকারীদের উপর দয়া করেন এবং তাদের জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। (ইবনে হিব্বান)
রোগী পরিদর্শনকারীর জন্য ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা
এ মর্মে দলীল হলঃ
আলী (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছিঃ যে কোন মুসলিম তার অপর মুসলমান রোগী ভাইকে দেখতে যায়, আল্লাহ্* তা’আলা তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করেন, তারা দিনের যে সময় সে দেখতে যায় সে সময় থেকে দিনের শেষ পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং সে রাতের যে সময় দেখতে যায় সে সময় থেকে রাতের শেষ পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। (আল মুসনাদ, ইবনে হিব্বান)
শায়খ আলবানী (রাহঃ) হাদীসটি সহীহ বলেছেন।
অন্য একটি বর্ণনাতে রোগীদের পরিদর্শনকারীর জন্য ফেরেশতাদের দরূদ এর অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে, এবং এও বলা হয়েছে যে, তাদের জন্য জান্নাতে একটি বাগান তৈরি করা হয়। হাদীসে এসেছে,
আলী (রা.) হতে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি সকাল বেলা কোন রোগীকে দেখতে গেল তার সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা যায় এবং তারা সবাই সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান নির্ধারণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় কোন রোগীকে দেখতে গেল, তার সাথে সত্তর হাজার ফেরেশতা যায় এবং তারা সবাই সকাল পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং তার জন্য জান্নাতে একটি বাগান নির্ধারণ করা হয়।
(আল মুসনাদ)
রোগী দেখতে যাওয়ার সওয়াব সম্পর্কে রাসুল (সা.) তার উম্মাতের জন্য অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা হতে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রোগী দেখতে গেল, সে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাহমতে আচ্ছন্ন থাকল এবং যখন সে রোগীর কাছে বসে তখন সে রাহমতের ভিতরে ডুবে থাকে। (আলো মুসনাদ, ইবনে হিব্বান)
শায়খ আলবানী হাদীসটির অধিক শাহেদের জন্য সহীহ বলেছেন। মোল্লা আলী কারী এ হাদীসটির ব্যাখ্যায় বলেন, রোগী দেখার নিয়্যাত নিজ বাড়ী থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহর রাহমতে প্রবেশ করে থাকে।
যখন সে রোগীর কাছে বসে, তখন সে আল্লাহর রাহমতে ডুবে যায়। রোগী দর্শনের জন্য যাওয়ার সময়ই শুধু রহমতে আচ্ছন্ন হয় না বরং বাড়ীতে ফেরার সময়ও তাকে আল্লাহর রহমত দ্বারা আচ্ছন্ন করেন। উপরোল্লেখিত হাদীসের শব্দ বাড়ী ফেরা পর্যন্ত আল্লাহর রাহমতে প্রবেশ করে তা প্রমাণ করে। পক্ষান্তরে রোগীর দেখাশুনা না করলে শাস্তি পেতে হবে। এ মর্মে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, “কিয়ামত দিবসে আল্লাহ্* তা’আলা বলেন, হে আদম সন্তান! আমি রোগে আক্রান্ত ছিলাম, তুমি আমার দর্শন সেবা করোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আপনি সারা বিশ্বের রব, আমি আপনার কেমনে সেবা করব? তিনি বললেন, তুমি কি জাননা, আমার অমুক বান্দা রোগাক্রান্ত ছিল? তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে সেখানেই আমাকে পেতে।” (মুসলিম)
ইমাম নববী (রহ.) আল্লাহ্* তা’আলার এরশাদঃ সেখানে আমার সওয়াব ও সম্মান পেতে। (মুসলিম, শারহে নববী)
আল্লামা মোল্লা আলী কারী (রা.) আল্লাহ্* তা’আলার বাণীর ব্যাখ্যায় বলেনঃ সেখানে আমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারতে।
রোগী ও মৃত ব্যক্তির পক্ষে ও বিপক্ষে মন্তব্যের উপর ফেরেশতাদের আমীন বলা
নিম্ন হাদীসটি এর উজ্জ্বল প্রমাণ।
উম্মে সালমা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমরা যখন কোন রোগী বা মৃত ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হবে, তখন ভাল দু’আ করবে, কেননা, ফেরেশতারা তা কবুল হওয়ার জন্য আমীন বলে থাকেন। (ইবনে মাজা)
হাদীসে উল্লেখিত শব্দের দু’টি অর্থ হতে পারেঃ (ক) মুমূর্ষ ব্যক্তি (খ) মৃত ব্যক্তি।
রোগীর নিকটে গেলে আল্লাহ্* তা’আলার সমীপে তার জন্য রোগ মুক্তির দু’আ করো এবং মৃত ব্যক্তির নিকট গেলে তার ক্ষমার জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করবে। অনুরূপ যে জায়গায় যাও নিজের জন্য ভাল কথাই বলবে। (মিরকাতুল মাফাতিহ)
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, এই হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে যে এ ধরনের স্থানে যেন উত্তম কথা বলা হয়। আল্লাহ তা’আলার নিকট রোগী বা মৃত্যর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় এবং তার প্রতি যেন মেহেরবানী, সহজ ও নরম ব্যবহার করা হয়। এ উদ্দেশ্যে দু’আ করা হয়ও তা কবুল হওয়ার জন্য ফেরেশতারা আমীন বলে থাকে। (শরহে নববী)
যেহেতু এ হাদীসে রোগী ও মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে ভাল উক্তিকারীর উক্তিকে কবুল হওয়ার জন্য আমীন বলার সুসংবাদ রয়েছে। অতএব, এমন স্থানে খারাপ উক্তি প্রকাশ ব্যাপারেও বিপদের আশংখা রয়েছে। কেননা, তাও কবুল হওয়ার জন্য ফেরেশতারা আমীন বলে থাকে। উল্লেখ্য জানাযার সময় ইমাম কর্তৃক বলা ইনি কি ভাল ছিলেন? আপনারা বলুনঃ হ্যাঁ তিনি ভাল ছিলেন। এরকম বলা নিশ্চিত বিদআত।
সৎকাজের শিক্ষা প্রদানকারীর জন্য
এরশাদ হচ্ছে,
আবু উমাম বাহেলী (রা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুল (সা.)-এর সামনে দু’ই ব্যক্তি সম্পর্কে বর্ণনা দেয়া হলোঃ যাদের একজন আলেম, অপরজন আবেদ (ইবাদতকারী)।রাসুল (সা.) বলেন, “আবেদের তুলনায় আলেমের মর্যাদা হলোঃ যেমন তোমাদের সর্বনিম্ন লোকের তুলনায় আমার মর্যাদা।” (তিরমিযী)
তারপর রাসুল (সা.) বললেন,
নিশ্চই মানুষকে ভাল কথা প্রদানকারীর প্রতি আল্লাহ্* তা’আলা দয়া করে থাকেন এবং ফেরেশতারা, আসমান ও জমীনের অধিবাসীরা এমন কি গর্তের পিপিলিকা ও পানির মৎস্যও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। (তিরমিযী)
হাদীসে মানুষকে উত্তম কথা শিক্ষা দেওয়ার অর্থ সম্পর্কে মোল্লা আলী কারী (রা.) বর্ণনা করেছেনঃ শিক্ষা বলতে এমন শিক্ষা যার সাথে মানুষের মুক্তি জড়িত। রাসুল (সা.) প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য ক্ষমার উল্লেখ করেননি; বরং মানুষের উত্তম শিক্ষা দাতার কথা বলেছেন। যেন তার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উক্ত ক্ষমার উপযুক্ত ঐ শিক্ষক যিনি মানুষকে কল্যাণের পথে পৌঁছার জন্য ইলম শিক্ষা প্রদান করে থাকেন।
মু’মিন ও মু’মিনদের আত্মীয় ও তাওবাকারীদের জন্য
এই মহা সত্যের বর্ণনা নিম্নের আয়াতগুলিতে রয়েছেঃ
“যারা আরশ বহনে রত এবং যারা তার চতুষ্পার্শে ঘিরে আছে, তারা তাদের রবের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তাতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মু’মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে, হে আমাদের রব! তোমার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব, যারা তাওবা করে এবং তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা করও এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর। হে আমাদের রব! তুমি তাদেরকে দাখিল কর স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাদেরকে দিয়েছ এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকে। তুমি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় এবং তুমি তাদেরকে শাস্তি হতে রক্ষা কর। সেদিন তুমি যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবে, তাকে তো অনুগ্রহই করবে; এটাই তো মহা সাফল্য।’’ (সূরা মু’মিনুনঃ৭-৯)
শেষ কথাঃ
উপরের আলোচনা থেকে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে যে, সব মানুষের কল্যাণের জন্য মালাকগণ দুআ করে না। বরং বিশেষ গুণ সম্পন্ন মানুষের প্রতি এ দু’আ করে থাকে। আর মুলতঃ এ কল্যাণের দু’আ আল্লাহই মালাকদের করতে বলেন। কেননা, মালাকগণ তো নিজে কিছু করতে পারে না। সুবহান্নাল্লাহ! মালাকগণ মানুষের জন্য দু’আ করবে এটা কত বড় সুভাগ্যবান বিষয়। অথচ অনেক মানুষ আজ এ কাজ গুলো করছে না। তারা মাজারে ও মৃত্যু অলীর নিকট দু’আর জন্য আবেদন করছে। নাউযুবিল্লাহ।
আসুন ! আপনি যদি মালাকদের আশীর্বাদ ও কল্যাণের দু’আ নিয়ে নিজেকে ধন্য করতে চান। তাহলে উপরোক্ত কাজগুলো আমল করুন। মালাকগণ সর্বদা নজরদারিতে আছে। যখন কোন নারী – পুরুষ উক্ত আমলসমূহ করবে তখনই তার উপর মালাকগণ দু’আ শুরু করবেন। আল্লাহ আমাদেরকে মালাকদের দু’আ নেওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে কবুল করুন। আমীন।